ফরাসি প্রতিষ্ঠান এয়ারবাস থেকে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এবার একই প্রতিষ্ঠান থেকে বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এমন সিদ্ধান্তের জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
গতকাল সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মাখোঁ এ মন্তব্য করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাশে রেখে এমানুয়েল মাখোঁ বলেন, ‘ইউরোপীয় অ্যারোনটিকসে (বিমানকৌশল) আস্থা রাখার জন্য এবং ১০টি এ-৩৫২ নেওয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’
বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চলমান ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সার্বভৌম নীতি, স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন প্রকাশ করেছে ফ্রান্স।
শীর্ষ বৈঠকের পর গতকাল সন্ধ্যায় প্রচারিত যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ শান্তি, সমৃদ্ধি এবং জনগণের কল্যাণে দুই দেশের অংশীদারত্বকে ‘কৌশলগত’ পর্যায়ে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দুই শীর্ষ নেতা যেকোনো দেশে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন এবং সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের নিন্দা জানিয়েছেন।
দিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পর এমানুয়েল মাখোঁ গত রোববার সন্ধ্যায় ঢাকায় আসেন। সফরের প্রথম দিন তিনি তাঁর সম্মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেন। পরে ফরাসি প্রেসিডেন্ট গানের দল ‘জলের গান’-এর সংগীতশিল্পী, গীতিকার ও বাদ্যযন্ত্রী রাহুল আনন্দর ধানমন্ডির বাসার নিজস্ব স্টুডিওতে গান শোনেন এবং শিল্পীর সঙ্গে আলাপ করে সময় কাটান।
সফরের দ্বিতীয় দিন সকালে এমানুয়েল মাখোঁ ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পরিদর্শনে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে দুটি চুক্তি সই হয়। এই চুক্তিগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) এবং বঙ্গবন্ধু-২ আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম–সম্পর্কিত ফ্রান্সের এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস এসএএসের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে সম্মতিপত্র (লেটার অব ইনটেন্ট—এলওআই)। অন্যটি হচ্ছে নগর সুশাসন ও অবকাঠামো কর্মসূচির বিষয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং ফ্রান্সের ফ্রান্স উন্নয়ন সংস্থার (এএফডি) মধ্যে ২০ কোটি ডলারের ঋণসহায়তা চুক্তি।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের পর ভাদ্রের বৃষ্টিতে তুরাগ নদে নৌকায় ঘুরে বেড়ান এমানুয়েল মাখোঁ। এরপর বেলা তিনটার দিকে এমানুয়েল মাখোঁ ঢাকা ছেড়ে যান।
বার্তা সংস্থা বাসস জানায়, গতকাল সকাল ১০টার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের পর দুই শীর্ষ নেতা একান্তে বৈঠক করেন।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক দিন, যা পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বিকশিত হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা, উন্নয়ন ও সুশাসনের ওপর ভিত্তি করে এই নতুন সম্পর্কের ভিত রচিত হয়।
বাংলাদেশের বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অবকাঠামো উন্নয়নে ফ্রান্স আমাদের অব্যাহত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। তারা বাংলাদেশের কৌশলগত নিরাপত্তা অবকাঠামো নির্মাণে উন্নত ও বিশেষায়িত প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে আগ্রহ দেখিয়েছে।’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের পর গতকাল সন্ধ্যায় যৌথ বিবৃতি প্রচার করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়, দুই শীর্ষ নেতা বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের সমর্থনে একটি আস্থাশীল ও অর্থপূর্ণ অংশীদারত্ব গড়ে তোলার অভিন্ন প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
দুই দেশ মনে করে, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ার কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্যদ্রব্যের সার্বভৌমত্ব, খাদ্যনিরাপত্তা এবং পুষ্টির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বাংলাদেশ ও ফ্রান্স নিয়মিত সংলাপের মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তার সমর্থনে টেকসই ও স্থিতিস্থাপক খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থায় তাদের সহযোগিতা জোরদার করতে রাজি হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দুই দেশ বিশ্বের সব জাতির আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে। তারা যুদ্ধের বৈশ্বিক পরিণতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। কারণ, এটি আর্থিক, অর্থনৈতিক এবং খাদ্য ও জ্বালানিনিরাপত্তার ওপর প্রভাব ফেলে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একসঙ্গে যুক্ততার বিষয়ে দুই দেশ তাদের প্রস্তুতির কথা জানায়।
যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আলোচনায় একমত পোষণ করেছে দুই দেশ। রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার জবাবদিহি নিশ্চিতের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার সমর্থনে ফ্রান্স আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার গণহত্যা মামলায় অন্যান্য অংশীদারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির কার্যক্রমে অতিরিক্ত ১০ লাখ ইউরোর অনুদান ঘোষণা করেছে ফ্রান্স।
বাংলাদেশ ও ফ্রান্স তাদের অংশীদারত্বের কৌশলগত মাত্রা আরও গভীর করতে নিয়মিত উচ্চপর্যায়ের সংলাপ শুরু করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট শান্তি, সমৃদ্ধি ও জনগণের জন্য অংশীদারত্বকে কৌশলগত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন।
যৌথ ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ফ্রান্স এয়ারবাস থেকে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। দুই দেশ বাংলাদেশের সব বিমানবন্দরে উন্নত উড়োজাহাজ চলাচল ব্যবস্থাপনায় অব্যাহত সহযোগিতার গুরুত্বের ওপরও জোর দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে ২০টির বেশি উড়োজাহাজ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং কোম্পানির তৈরি। এ ছাড়া কিছু ড্যাস-৮ টার্বোপ্রপ উড়োজাহাজও রয়েছে। গত মে মাসে লন্ডনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে এয়ারবাসের ১০টি উড়োজাহাজ কেনার বিষয়ে যৌথ ঘোষণায় সই হয়। ইউরোপের উড়োজাহাজ নির্মাণকারী এয়ারবাসের সঙ্গে এটাই হবে বাংলাদেশের প্রথম চুক্তি।
যৌথ ঘোষণায় ফ্রান্স এয়ারবাস থেকে ১০টি এ–৩৫০ কেনার জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। দুই দেশ বাংলাদেশের সব বিমানবন্দরে উন্নত এয়ার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় অব্যাহত সহযোগিতার গুরুত্বের ওপরও জোর দেয়।
দুই দেশ এয়ারবাস ডিএস এবং বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিএল) মধ্যে একটি মহাকাশ অংশীদারত্বের উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। যা মহাকাশে যুক্ততার বিষয়ে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে এবং নিজস্ব দক্ষতা অর্জনে সহায়ক হবে।