কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিণত হয়েছে খুনের জনপদে। চাঁদাবাজি, ইয়াবা-অস্ত্র ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তারসহ সাত কারণে এসব খুনোখুনি ঘটছে। গত ছয় বছরে ক্যাম্পে খুন হয়েছেন ১৯০ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত এক বছরে খুন হয়েছেন ৮৫ জন। যার মধ্যে সাধারণ রোহিঙ্গা যেমন রয়েছেন, রয়েছেন সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য, ক্যাম্পের মাঝি, সাব মাঝি ও রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা। এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সক্রিয় ৬০ উগ্র ও সন্ত্রাসী সংগঠন।
অপরাধবিজ্ঞানী অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে অপরাধীদের চিহ্নিত করে যৌথ সাঁড়াশি অভিযান করতে হবে। তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে জাতিকে মাশুল দিতে হবে। একই সঙ্গে সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়ে তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা জরুরি।’ কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুন, অপহরণসহ যাবতীয় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যৌথভাবে কাজ করছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হয়। একই সঙ্গে টহল জোরদার করা হয়েছে। বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সর্বাত্মকভাবে কাজ চলছে।’ তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পাহাড় দিয়ে ঘেরা ও দুর্গম। তা ছাড়া নানান প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করতে হয়। সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ক্যাম্পে কাজ করছে।’ জেলা পুলিশ ও রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তথ্যমতে, ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে সংঘাতপূর্ণ কক্সবাজারের ৩৩ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ক্যাম্পে ১৯০টির মতো হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ২০২২ সালের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত এক বছরে খুন হয়েছেন ৮৫ জন। এর মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে ৪৬ জন নিহত হয়েছেন। নিহতের দীর্ঘ এ তালিকায় সাধারণ রোহিঙ্গা যেমন রয়েছেন, তেমন রয়েছেন কমিউনিটি নেতা, স্বেচ্ছাসেবী কিংবা ধর্মীয় নেতা।
গত বছরের শেষের দিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নতুন করে যোগ হয়েছে টার্গেট কিলিং। আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করেই ঘটছে এ-জাতীয় খুন। টার্গেট কিলিংয়ে নিহতের মধ্যে রয়েছেন ১৮ রোহিঙ্গা মাঝি, ১২ জন আরসা সদস্য, একজন স্বেচ্ছাসেবী। বাকিরা সাধারণ রোহিঙ্গা। খুনের পাশাপাশি অপহরণও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। গত ছয় বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কমপক্ষে ৬ শতাধিক অপহরণ ঘটেছে। যদিও পুলিশের খাতায় এ সংখ্যা সাড়ে তিন শ। ২০২২ সালে হত্যা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, মানব পাচার, পুলিশের ওপর হামলাসহ নানান অপরাধে ২ হাজার ৫৩১ রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ সময় তাদের বিরুদ্ধে ১ হাজার ২২০টি মামলা হয়। তার আগের বছর ২০২১ সালে ১ হাজার ৬২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। মামলা হয়েছিল ৬৬৬টি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুন ও অপহরণের নেপথ্যে রয়েছে কমপক্ষে সাতটি কারণ। সেগুলো ক্যাম্পে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ, ইয়াবা ব্যবসা, মানব পাচার, অস্ত্র ব্যবসা, অপহরণ, আধিপত্য বিস্তার ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ১১টি সন্ত্রাসী গ্রুপ। এর মধ্যে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আর রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), ইসলামী মাহাজ, জমিয়তুল মুজাহিদীন, নবী হোসেন গ্রুপ, মুন্না গ্রুপ, ডাকাত হাকিম গ্রুপ ও ডাকাত সালেহ গ্রুপ সক্রিয়। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ৬০ সন্ত্রাসী গ্রুপের একটি তালিকা তৈরি করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। এ তালিকায় থাকা সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে মাস্টার মুন্না, নবী হোসেন, মৌলভী তৈয়ুব, কালা পুতু, আবু কালাম ওরফে জাবু জাকু, মো. ইসলাম, মাস্টার মো. আয়ুব, মহিব উল্লাহ, কাইনুস, মোস্তাক আহমেদ, মো. ইসলাম, মো. জামাল হোসেন, শাহ নেওয়াজ, জয়নাল হোসেন, আবদুল আমিন ওরফে কালু ডাকাত, রুবেল, রুয়াইয়া ওরফে রবি, জামাল হোসেন, মো. দেলোয়ার, মো. হামিদ, করিম উল্লাহ, মো. ওসমান ছোট, সৈয়দ নুর, জিয়াবুর রহমান ওরফে জাবু, সলিম, ইলিয়াছ, আবুল হাফেজ, কালাইচ্ছা, মো. আয়াজ, আবদুল আমিন, মো. তৈয়ুব, মো. আলম ওরফে নালা, মো. কামাল হোসেন, মো. সাদ্দাম, দিদার আহমেদ ওরফে নাইগ্যা, মো. এমরান হোসেন, জাফর আলম ওরফে ভুলু ডাকাত, খোকন, ইব্রাহীম, মো. নুর, মো. রফিক, আবদুর রজব, রিদুয়ান, শালবাগান ওসমান গণি ওরফে আয়াছ, নুর হোসেন ওরফে মুনিয়া, করিম উল্লাহ, মোবারক হোসেন, মো. সাইফুল, ইয়াসিন, মো. আলম, হারুন ডাকাত, মো. সাদেক, আবদুর রহমান, মো. ইসমাইল, মো. ইসহাক, মো. হারুন ও ইমাম হোসেন অন্যতম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক মাঝি বলেন, আধিপত্য বিস্তার এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণ নিয়েই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুনের ঘটনাগুলো ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে খুনের বদলা নিতেও খুন হচ্ছে। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর কারণে আতঙ্কে দিন কাটছে সাধারণ বাসিন্দাদের।