এই মৃত্যুর মিছিল কি থামবে না!

সাভারে গত ৩১ আগস্ট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রওনক মৃধা নামে এক স্কুলছাত্রীর মৃত্যু হয়। তার বয়স ছিল ১১ বছর, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছিল শিশুটি। স্বজনরা জানান, ৩১ আগস্ট সাভার এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে রওনককে আইসিইউতে নেওয়া হয়। সেদিন বিকালেই তার মৃত্যু হয়।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৫ বছরের কম বয়সী শিশু মারা গেছে ৭৫ জন। আর ১৬ বছর থেকে ২০ বছর বয়সী মারা গেছে ৪৪ জন। অর্থাৎ এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ১১৯ জন শিশু-কিশোর মারা গেছে ডেঙ্গুতে।

এছাড়া ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৬ বছরের কম বয়সী ২৫ হাজার ১২৫ জন। ১৬ থেকে ২০ বছর বয়সী হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১৭ হাজার ১৪০ জন।

দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার ৩০২ জন। অর্থাৎ আক্রান্তদের ৩২ শতাংশ শিশু-কিশোর।

বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে এই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা ১ হাজার ৯৬ জন। এরমধ্যে মারা গেছে ১৪ জন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের দেরিতে হাসপাতালে আনার কারণে জটিলতা বেশি তৈরি হচ্ছে। এতে অনেকেরই প্লাটিলেট কাউন্ট দ্রুত কমে যাচ্ছে।

শিশু হাসপাতালের পরিচালক ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ডেঙ্গুসহ যেকোনও অসুখে শিশুরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। বিশেষ করে এক বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের ডেঙ্গু হলেই পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের পালমোনারি হেমারেজ (শ্বাসতন্ত্রের রক্তক্ষরণ) বেশি হয়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে না পারলে মালটি-অরগান ফেইলিয়র (শরীরের ভেতরের বিভিন্ন অঙ্গ অকেজো) হয়ে শিশু মারা যেতে পারে।

চলতি বছরের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের মধ্যে ৫৭৬ জন মারা গেছেন। এরমধ্যে ৬৪ শতাংশ রোগীরই মৃত্যু হয়েছে শক সিনড্রোমে। আবার শক সিনড্রোমে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশনের বাইরে। বাংলাদেশের ডেঙ্গুর সার্বিক অবস্থা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ছাড়াও মৃত্যুর অন্যান্য কারণের মধ্যে এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে ২৩ শতাংশ, হেমোরোজিক ফিবারে ৯ শতাংশ ও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কোমরবিডিটি রোগী ৪ শতাংশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা সিটির বাইরে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ ঢাকার বাইরে ৭৩ শতাংশ মৃত্যুই হয়েছে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে। অন্যদিকে ঢাকায় শক সিনড্রোমে মৃত্যু হয়েছে ৬৩ শতাংশের।

চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের উপসর্গ হলো শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হওয়া কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাওয়া। ত্বক শীতল হয়ে যাওয়া। ত্বকের ভেতরের অংশে রক্তক্ষরণের কারণে ত্বকের ওপর লাল ছোপ সৃষ্টি হওয়া। বমি, মল কিংবা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, প্রচণ্ড পেটব্যথা ও অনবরত বমি হওয়া, নাক ও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ ও অবসাদ। কখনও মস্তিষ্কের ভেতরেও রক্তক্ষরণ হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মতে, দেরি করে চিকিৎসা নিতে আসায় মৃত্যু বাড়ছে। হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মধ্যে মারা যাচ্ছে অধিকাংশ রোগী। অর্থাৎ যখন রোগীরা আসছেন তখন চিকিৎসকের কিছুই করার থাকছে না। তাই জ্বর হলে দ্রুত পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশীদ উন নবী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মানুষ যদি শক সিনড্রোমের আগেই চিকিৎসা নেওয়া শুরু করে তাহলে রোগী সুস্থ হয়ে যায়। অনেক সময় রোগীর প্লাটিলেট কমে যায়, রক্তক্ষরণ হয়। তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি হচ্ছে শক সিনড্রোম। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় বাসায় বসে আছে, প্লাটিলেট কমে না, ব্লিডিং হয় না, কিন্তু শকে চলে গেছে। দেরি করে যদি আসে তাহলে সেক্ষেত্রে কিন্তু রিকভার করা অসম্ভব হয়ে যায়। এজন্য আমরা পরামর্শ দেই জ্বর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং ফলোআপের ওপর থাকুন।

এদিকে সোমবার মন্ত্রণালয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক ডেঙ্গু সংক্রমণ ও এতে মৃত্যুর হার প্রসঙ্গে বলেছেন, মৃত্যুটা বেশি হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা বলতে চাই যে অনেক সময় চিকিৎসা নিতে দেরি হচ্ছে। দেরি হলে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানো কঠিন হয়ে যায়। সে জন্য জ্বর হলেই ডেঙ্গু টেস্ট করে নিন। দ্রুত হাসপাতালে আসেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *