অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বেশিরভাগ সূচক নিম্নমুখী থাকলেও এতদিন প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল তুলনামূলক গতিশীল। এবার এই রেমিট্যান্স প্রবাহ নিয়ে উদ্বেগজনক তথ্য দিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। গত আগস্টে প্রবাসীরা যে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন—তা গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, গত বছরের আগস্টের তুলনায় সদ্য বিদায়ী আগস্টে রেমিট্যান্স কমেছে ২১.৫৭ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের আগস্টে রেমিট্যান্স (বৈধ চ্যানেলে) এসেছিল প্রায় ২.০৪ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়া, গত চার বছরের আগস্ট মাসের তুলনায় এ বছরের আগস্টেই সর্বনিম্ন পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। যা কমতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও আগের যেকোনও সময়ের চেয়ে বিভিন্ন দেশে শ্রমিক রফতানি বেড়েছে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৬ লাখ ১৮ হাজার শ্রমিক। আর গত বছর (২০২২) শ্রমিক গেছেন রেকর্ড পরিমাণ ১১ লাখ ৩৬ হাজার। বিদেশে এভাবে শ্রমিক যাওয়া বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই রেমিট্যান্স বাড়ার কথা। কিন্তু রেমিট্যান্সের এই নিম্নমুখী প্রবণতা থেকে বের হতে পারছে না বাংলাদেশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রবাসীরা গত জুন মাসে পাঠিয়েছিলেন ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার। পরের মাস জুলাইয়ে রেমিট্যান্স আসে ১৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর আগস্টে এসেছে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার। জুলাইয়ে দেশের ব্যাংকিং বা বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে মোট ১.৯৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। এই হিসাবে, জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে রেমিট্যান্স কমেছে ১৮.৭৮ শতাংশ।
প্রবাসী আয়ের এই পতনের বিষয়ে ব্যাংকাররা বলছেন, বাজার দরের চেয়ে ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ডলারের কম দাম দিচ্ছে প্রবাসীদের। এতে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে, বেড়ে গেছে হুন্ডি।
আগস্ট মাসে ব্যাংক খাতে ডলারের দর ছিল ১০৯ টাকা। সেখানে হুন্ডিওয়ালারা ১১৭ থেকে ১১৯ টাকা দরে প্রতি ডলারের সমপরিমাণ বাংলাদেশি টাকা প্রবাসীদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে।
বেশিরভাগ ব্যাংক কর্মকর্তার মন্তব্য হলো—খোলা মুদ্রাবাজারে ডলারের দাম বেশি থাকায় প্রবাসীরা হুন্ডির মাধ্যমকে বেছে নিয়েছে। এ কারণে আনুষ্ঠানিক বা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্সের এমন পতন হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকের সঙ্গে খোলাবাজারে ডলারের দামের পার্থক্য প্রায় ৮ টাকা। আর ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারের রেট অনেক বেশি হওয়ায় হুন্ডিতে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন প্রবাসীরা। বিশেষ করে প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে যাদের মাসিক আয় কম এবং যারা অবৈধ, তারা হুন্ডিতেই টাকা পাঠাতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে কমে যাচ্ছে রেমিট্যান্স।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো অর্থনীতিবিদ তৌফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘হুন্ডির প্রসার যেখানে কমার কথা, সেখানে এর চাহিদা বাড়ছে। ফলে সম্প্রতি হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর প্রবণতাও বেড়েছে।’
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রেমিট্যান্স তখনই বাড়বে, যখন ডলারের দর বাজারভিত্তিক হবে। এখন মানুষ প্রতি ডলারের বিপরীতে পাচ্ছে ১১৮ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক ১০৯ টাকার মধ্যে রাখার চেষ্টা করছে। এটা ভালো কোনও চর্চা নয়।’ তিনি বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণ না করলে স্বাভাবিকভাবে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়তো। কিন্তু নিয়ন্ত্রণে থাকতে চায় না। এ কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে।’
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ডলারের দর বাজারভিত্তিক না করার কারণে রেমিট্যান্স বাড়ছে না। বিশ্বব্যাংকের এক বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে, অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে দর এক শতাংশ বেশি হলেই সাড়ে ৩ শতাংশ রেমিট্যান্স সেখানে চলে যায়।’
তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে ব্যাংকগুলো একটি দর ঘোষণা করলেও হুন্ডিওয়ালারা তার চেয়ে বেশি দামে ডলারের মূল্য বাসাবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছে। যে কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডি চ্যানেল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।’
চলতি সেপ্টেম্বর মাস ও আগামী মাসগুলোতেও এই নিম্নমুখী প্রবণতা থাকতে পারে বলে মনে করছেন খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর না হলে রেমিট্যান্স প্রবাহে হয়তো গতি আসবে না। একাধিক বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীও মনে করেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে অর্থপাচারকারী হুন্ডিচক্রের একটি যোগসূত্র থাকতে পারে। এছাড়া আন্ডার ইনভয়েসিং এবং অর্থপাচারের কারণে হুন্ডি বেড়েছে। কিছু দিন আগে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রায় অর্ধেক রেমিট্যান্স এখন হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে আসছে।
নাম প্রকাশ না করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী (এমডি) বলেন, কিছু দিন আগেও রেমিট্যান্স আহরণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর যে উদ্যোগ ছিল, তাতে বর্তমানে কিছুটা ভাটা পড়েছে। রেমিট্যান্স আহরণের জন্য আগে সৌদি আরব, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক তাদের কর্মকর্তাদের পাঠাতেন। তারা বছরের পর বছর মধ্যপ্রাচ্যের ওই দেশগুলোতে থাকতেন, কিন্তু বর্তমানে ওই কর্মকর্তাদের দেশে ফেরত আনা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)-এর সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘হুন্ডির চাহিদা কমাতে হবে। হুন্ডিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটি যতক্ষণ পর্যন্ত না কমানো হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত যত উদ্যোগই নেওয়া হোক না কেন, রেমিট্যান্স খুব বেশি বাড়বে না।’
প্রসঙ্গত, হুন্ডি বন্ধের বছর তথা ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যায়। রিজার্ভও সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। এই স্ফীতির প্রধান কারণ করোনা মহামারির সময় হুন্ডি ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়েছিল। করোনা চলে যাওয়ার পরের অর্থবছরে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স পাঠানো আবার চাঙা হয়ে ওঠে। তখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ৩৫৭ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ৫৬ কোটি ডলার বা ১৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ কম। অথচ করোনার মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল রেকর্ড ২৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার।
ব্যাংকাররা জানান, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স ও রফতানিতে ডলার কেনার সর্বোচ্চ দর ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা বেঁধে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ওপর আড়াই শতাংশ হারে প্রণোদনা পাচ্ছেন প্রবাসীরা। যদিও খোলাবাজারে ডলারের দাম এখন ১১৫ থেকে ১১৭ টাকা।
অনেকেই বলছেন, এই হুন্ডির পেছনে সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক মুদ্রানীতি ও অর্থপাচারই মূলত দায়ী। ডলারের বিনিময়ে টাকার মূল্যমান বাজারের হাতে ছেড়ে না দিয়ে সরকার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, যার ফল হয়েছে হিতে বিপরীত। সরকারের বেঁধে দেওয়া হারের চেয়ে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি।
সম্প্রতি রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, মালদ্বীপ থেকে ৬৬ শতাংশ শ্রমিক হুন্ডিতে টাকা পাঠান। তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশের ব্যাংক হিসাবই নেই। দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশ মালদ্বীপে বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিক আছেন দুই লাখের মতো। বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক সোয়া এক কোটি। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশ থেকে কী পরিমাণ প্রবাসী আয় হুন্ডির মাধ্যমে আসে, তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে।
অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলছেন, রেমিট্যান্স এভাবে কমে আসার কারণ তারা উদঘাটনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি উল্লেখ করেন, কী কারণে হঠাৎ রেমিট্যান্স কমে গেলো, তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ রেমিট্যান্স কেন কমেছে তা অনুসন্ধান করছে। ডলার কেনাবেচার সঙ্গে রেমিট্যান্স কমার কোনও যোগসূত্র আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। মেজবাউল হক বলেন, ‘রেমিট্যান্স যাতে না কমে সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু ব্যাংককে নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। বেশ কিছু মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে ও কিছু মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে।’
এদিকে রেমিট্যান্স বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। সেবার বিনিময়ে দেশে রেমিট্যান্স আয় আনতে ফরম-সি পূরণ করার শর্ত শিথিল করেছে। পাশাপাশি সেবা খাতের উদ্যোক্তা ও রফতানিকারকদের ঘোষণা ছাড়াই ২০ হাজার মার্কিন ডলার বা সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বৈধ উপায়ে ওয়েজ আর্নার্স রেমিট্যান্সের বিপরীতে আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা, রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের সিআইপি সম্মাননা দেওয়া, রেমিট্যান্স বিতরণ প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ ও সহজ করার পাশাপাশি অনাবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগ ও গৃহায়ন অর্থায়ন সুবিধা দেওয়া হয়েছে।