ইসরায়েলে হামলার মাস্টারমাইন্ড দেইফ (তিনি অধরা। তিনি আড়ালের মানুষ)

ইসরায়েলে হামলার মাস্টারমাইন্ড

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের শনিবারের ভয়াবহ হামলাকে নিজেদের ৯/১১ মুহূর্ত হিসেবে উল্লেখ করছে ইসরায়েল। এর নেপথ্যে মাস্টারমাইন্ড ফিলিস্তিনি কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ এই হামলাকে ‘আল আকসা প্লাবন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে তার সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

ওই দিন গাজা উপত্যকা থেকে হাজারো রকেট ইসরায়েলি ভূখণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। কয়েকশ’ যোদ্ধা সীমান্তের ব্যারিকেড ভেঙে ইসরায়েলে প্রবেশ করে তাণ্ডব চালায়। হামলার সময় রেকর্ডকৃত অডিও বার্তায় তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদে ইসরায়েলি অভিযানের প্রতিশোধ নিতে এই হামলা চালানো হয়েছে।

২০২১ সালের মে মাসে ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থানে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে আরব ও মুসলিম বিশ্বে ক্ষোভের জন্ম দেয়। হামাসের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, ওই সময় থেকেই এই হামলার পরিকল্পনা করতে শুরু করেন দেইফ। এখন পর্যন্ত এই হামলায় ইসরায়েলে ১ হাজার ২০০ জন নিহত ও ২ হাজার ৭০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।

গাজাভিত্তিক সূত্রটি জানায়, রমজানে আল আকসা মসজিদে ইসরায়েলের তাণ্ডব, মুসল্লিদের মারধর, হামলা, বয়স্ক ও তরুণদের টেনেহিঁচড়ে বের করার ছবি ও ফুটেজ হামলার পরিকল্পনার দিকে নিয়ে যায়। এগুলো আগের ক্ষোভকে আরও উসকে দেয়। মসজিদে তাণ্ডবের ঘটনায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে ১১ দিনের সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।

ওই ঘটনার দুই বছরের বেশি সময় পর শনিবারের হামলাটি ১৯৭৩ সালের পর ইসরায়েলি প্রতিরক্ষার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। পরিণতিতে ইসরায়েল যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। গাজায় পাল্টা হামলা চালিয়ে ১ হাজার ৫৫ জনকে হত্যা ও পাঁচ সহস্রাধিককে আহত করেছে। বুধবার ইসরায়েল বলেছে, গাজা থেকে প্রবেশ করা অন্তত ১ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীকে তারা হত্যা করেছে।

ইসরায়েলের সাতটি গুপ্তহত্যার চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া দেইফ খুব কম কথা বলেন এবং প্রকাশ্যে খুব বেশি আসেন না। সর্বশেষ ২০২১ সালে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ফলে হামাসের টিভি শনিবার যখন ঘোষণা দেয় তিনি কথা বলবেন তখন ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারছিলেন বড় ধরনের কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

রেকর্ডকৃত অডিও ভাষণে তিনি বলেছেন, আজ আল আকসা, আমাদের জনগণ ও জাতির ক্রোধ বিস্ফোরিত হচ্ছে। আমাদের মুজাহিদিনরা (যোদ্ধা), আজ অপরাধীদের জানিয়ে দেওয়ার দিন যে তাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে।

দেইফের মাত্র তিনটি ছবি রয়েছে। একটি তার বয়স যখন বিশের কোঠায়, অপরটিতে মুখে মাস্ক পরা এবং তৃতীয়টি তার ছায়ার একটি ছবি। অডিও বক্তব্য সম্প্রচারের সময় ছায়ার ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে।

দেইফ কোথায় রয়েছেন তা অজ্ঞাত। যদিও মনে করা হয় তিনি গাজার সুড়ঙ্গে থাকতে পারেন। ইসরায়েলের একটি গোয়েন্দা সূত্র বলেছে, এই হামলার পরিকল্পনা ও অভিযানিক বিষয়ে সরাসরি জড়িত দেইফ।

ফিলিস্তিনি সূত্রগুলো বলছে, গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় বিধ্বস্ত একটি বাড়ি দেইফের বাবার। হামলায় দেইফের ভাই ও পরিবারের আরও দুই সদস্য নিহত হয়েছে।

দুই মাথা, এক মাস্টারমাইন্ড

হামাস ঘনিষ্ঠ সূত্রমতে, হামলার প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত যৌথভাবে নিয়েছেন আল কাসেম ব্রিগেডের কমান্ডার দেইফ ও গাজার হামাস নেতা ইয়েহিয়া সিনওয়ার। তবে নাটের গুরু কে তা স্পষ্ট।

সূত্রমতে, এ ক্ষেত্রে দুটি মস্তিষ্ক ছিল, কিন্তু মাস্টারমাইন্ড ছিলেন একজন। এই পরিকল্পনার বিষয়টি হামাসের অল্প কয়েকজন নেতা জানতেন।

হামাসের ভাবনার সঙ্গে পরিচিত একটি আঞ্চলিক সূত্র জানিয়েছে, গোপনীয়তা এত কঠোর ছিল যে ইসরায়েলের চিরশত্রু এবং হামাসের অস্ত্র ও অর্থের গুরুত্বপূর্ণ উৎস ইরানও এই বিষয়ে খুব বেশি জানতো না। সাধারণভাবে তারা জানত যে একটি বড় অভিযানের পরিকল্পনা হচ্ছে, কিন্তু সময় বা বিস্তারিত অবগত ছিল না।

হামাসের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, দেইফের এই পরিকল্পনায় দীর্ঘ প্রচেষ্টার মাধ্যমে ইসরায়েলকে ধোঁকা দেওয়ার উদ্যোগ ছিল। ইসরায়েলকে বিশ্বাস করানো হয় যে হামাস নতুন সংঘাত শুরুতে আগ্রহী নয়, তারা গাজার অর্থনৈতিক উন্নয়নে মনোযোগী। কিন্তু ইসরায়েল যখন গাজার শ্রমিকদের কাজের সুযোগ দিতে শুরু করে তখন হামাস যোদ্ধারা নিজেদের প্রশিক্ষিত করে তোলে। অনেক সময় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর চোখের সামনে এই প্রশিক্ষণ চলতে থাকে।

হামাসের বহিঃসম্পর্ক প্রধান আলি বারাকা বলেন, এই লড়াইয়ের জন্য আমরা দুই বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছি।

১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর গাজায় প্রতিষ্ঠিত খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে মোহাম্মদ মাসরি নামে ১৯৬৫ সালে জন্ম দেইফের। ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদা বা ফিলিস্তিনি জাগরণের সময় হামাসে যোগ দিয়ে তিনি মোহাম্মদ দেইফ হিসেবে পরিচিতি পান। ১৯৮৯ সালে ইসরায়েল তাকে গ্রেফতার করেছিল। ওই সময় ১৬ মাস তিনি কারাগারে ছিলেন।

গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক অর্জন করেছেন তিনি। তার অধ্যয়নের বিষয় ছিল পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান। শিল্পকলার প্রতি তার আগ্রহ ছিল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদন কমিটির প্রধান ছিলেন এবং মঞ্চে রম্য নাটকে অভিনয় করেছিলেন।

হামাসের নেতৃত্বে উঠে আসার পর দেইফ সুড়ঙ্গের একটি নেটওয়ার্ক ও বোমা বানানোর দক্ষ টিম গড়ে তোলেন। কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় সবার উপরে রয়েছে তার নাম। আত্মঘাতী বোমা হামলায় কয়েক ডজন ইসরায়েলি নিহতের জন্য তাকে ব্যক্তিগতভাবে দায়ী করা হয়।

দেইফের জন্য আড়ালে থাকা জীবন-মৃত্যুর বিষয়। হামাস সূত্র জানিয়েছে, ইসরায়েলি হত্যাচেষ্টায় তিনি একটি চোখ হারিয়েছেন। এক পায়েও বড় ধরনের আঘাত পেয়েছেন। ২০১৪ সালে ইসরায়েলি বিমান হামলায় তার স্ত্রী, ৭ মাসের ছেলে ও ৩ বছরের মেয়ে নিহত হয়েছে।

ইসরায়েলের একাধিক হত্যা প্রচেষ্টার পরও বেঁচে থাকা এবং হামাসের সামরিক শাখা পরিচালনায় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তিনি বীরের মর্যাদা অর্জন করেছেন। ভিডিওতে তিনি মাস্ক পরা অবস্থায় থাকেন অথবা শুধু তার ছায়া দেখা যায়। স্মার্টফোনের মতো আধুনিক প্রযুক্তি তিনি ব্যবহার করেন না।

হামাস সূত্রমতে, ‘তিনি অধরা। তিনি আড়ালের মানুষ।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *