উচ্চশিক্ষার ‘ইঁদুরদৌড়’; বেনিয়াদের তৈরি ফাঁদ !

আমাদের সমাজে প্রচলিত যে শিক্ষা ব্যবস্থা তাতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে অনেকের মধ্যেই অনেক ধরনের ধ্যান-ধারণা প্রচলিত আছে। আসলে আমরা শিক্ষা আর প্রশিক্ষণ দুটার মধ্যে পার্থক্য বুঝার মত চিন্তা করি না। যার কারণেই আমাদের আসলে এই বিষয় নিয়ে একটা ঝাপশা ধারণা থেকে যায়। আমরা যে উচ্চশিক্ষা অর্জন করি, সেখানে আসলে আমাদেরকে একটি স্পেসিফিক বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা হয়।

উচ্চশিক্ষা

উচ্চশিক্ষার ‘ইঁদুরদৌড়’; বেনিয়াদের তৈরি ফাঁদ !

মনে করুন,একজন অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছে। তার চিন্তা থাকবে যে সে উক্ত বিষয়ে কাজ করবে। আমাদের মত জনবহুল দেশে তো আসলে এতো কাজ নাই যে তার এই শিক্ষাটা কাজে লাগাতে পারে। যার ফলে কিছু মানুষ বেকার থেকে যায়। আমি এই বিষয়ে কাউকে দোষ দেবো না কারণ এখানে আমাদের সিস্টেমের কিছু ভুল আছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পড়াশোনা করে প্রতি বছর যে সকল ছেলেমেয়েরা বের হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই বেকার থেকে যাচ্ছে বা তারা যে বিষয়ে পড়াশোনা করেছে সে বিষয়ে কাজ পাচ্ছে না। এই বিষয়টি কি আসলে আমরা কিভাবে চিন্তা করব? কেউ বলবেন এটা সরকারের ব্যর্থতা, রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, সমাজের ব্যর্থতা ইত্যাদি।

প্রথমত; আমাদের যে পরিমাণ শিক্ষিত তরুণ গ্র্যাজুয়েট বা মাস্টার্স পাশ করা ছেলে-মেয়ে বেরিয়ে আসছে তাদের দেবার মত কাজ আমাদের দেশে এখনো তৈরি হয়নি। দ্বিতীয়ত; এই সমস্যায় যে আমরাই শুধু পড়েছি তা কিন্তু নয়। আমাদের আগেও বিশ্বের অনেক ওভার পপুলেটেড দেশ এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। আর সে সকল দেশ এই সমস্যার সমাধান বের করে আজ বিশ্বের বুকে অনেক শক্ত অর্থনৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি চায়নার কথা। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ। সে দেশের একসময়কার অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক এবং ভঙ্গুর ছিল। তারা শুধুমাত্র তাদের জনশক্তিকে দক্ষতার সাথে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে গিয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিযোগীতায়।

আমরা এখান থেকে কি শিক্ষা নিতে পারি? আমাদের অধিকাংশ মা বাবার মনে করেন তাদের ছেলে মেয়ে পড়াশোনা করে সরকারি চাকরি করবে, কর্পোরেট কোম্পানিতে হাইপেইড স্যালারি জব করবে। কিন্তু কম্পিটিশনের বাজারে আমাদের অনেকেই সেই লক্ষ্য পূরণ হয় না। যার কারণে অনেকেই হতাশ হন। অথচ চায়না যখন চার দশক আগে দেখতে পেল যে তারা ভার্সিটি থেকে পাস করে বেরোনো তরুণদের চাকরি দিতে পারবেনা, তখন তাদের ভার্সিটি এডুকেশনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় সরকার। আমার এক ছোট ভাই সে চায়নাতে পড়াশুনা করে বাংলাদেশে এসেছে। আমাকে বলেছ যে চায়নাতে প্রতি পাঁচ হাজার জনের মধ্যে একজন ছাত্র ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পায় এবং সেই একজন সর্বোচ্চ মেধা সম্পন্ন। বাকি শিক্ষার্থীদের কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করে বিভিন্ন কোম্পানির সাথে চুক্তি করে তাদেরকে সেখানে চুক্তিভিত্তিক কাজ দেয়া হয়।। মজার বিষয় হল সে কাজগুলো করার জন্য তাদের কোন ফ্যাক্টরিতে যাওয়া লাগে না। বাড়িতে বসেই সকল কাজ করে বিনিময়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। ফলে তার দেশ থেকে বেকারত্ব দূর হচ্ছে। আজ দেড়শ কোটির অধিক জনগণ নিয়েও চায়নাতে বেকারের সংখ্যা শূন্য।

দুঃখজনক হলেও আমাদের দেশের শিক্ষাকে প্রাইভেট সেক্টরে দিয়ে দেয়ায় যে সমস্যাটা হয় সেটি হল ‘শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ’। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে আমাদের সমাজে যে শিক্ষা নিয়ে ভুল ধারণা মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে সেই বিষয়েই আজকে আমি কিছু আলোচনা করব। আমার আলোচনার বিষয়টি পুরোটাই আমার নিজস্ব মতামত এবং গবেষণার লব্ধ। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বা শিক্ষা ব্যবসার একটি অন্যতম অংশ হচ্ছে প্রচারণা বা মার্কেটিং। এর মাধ্যমে মানুষকে আসলে শিক্ষা পণ্য বা সেবা নেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। এবং সেই উদ্বুদ্ধ করার প্রক্রিয়াটা থাকে খুবই চমকপ্রদ এবং চটকদার। আমাদের সাধারণ মানুষরা সাধারণত সেই বিজ্ঞাপন বা মার্কেটিং এর কারণেই সেই সেবা নিতে খরচ করতে আগ্রহী হই। স্বাভাবিকভাবেই আমাদেরকে মার্কেটিং এর স্বার্থে কোন একটা বিষয় চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করা হয়। অনেক সময় বলা হয় সন্তান অমুক বিষয়টি নিয়ে পড়লে তাকে আর কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না, কোম্পানি নিজে এসে জব দিব্ হেন তেন ইত্যাদি। আর এখানেই একজন অভিভাবক সবচেয়ে বড় ভুলটা করেন। সন্তান কোন বিষয়ে ভালো পারবে, কোন বিষয়টা তার কাজে লাগবে, সেটা চিন্তার না করে ওই মার্কেটিং এর দেখানো বিষয়টিকেই সন্তানের জীবনের লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করে ফেলেন। আবার শিক্ষার্থী বেচারাও জীবনের সঠিক জ্ঞান না থাকায় সেই মার্কেটিং এর ফাঁদে পা দেয়। চার বা পাঁচ বছর পড়াশোনার করে বের হওয়ার পরে ওই বিষয়ের চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে তখনই তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়।

মনে করেন, পুরো বাংলাদেশ ওই বিষয়ে শিক্ষিত লোকের জন্য পদ খালি আছে এক হাজার, আর প্রতি বছর পাশ করে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে প্রায় বিশ হাজার। এখন বাকি যে গ্রাজুয়েট থাকবে তারা কোথায় যাবে? কি কাজ করবে? এই চিন্তা আমরা অনেকেরই মাথায় আসে না। শিক্ষার্থীদের সাথে বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন না সমাজের কেউই। যার ফলে বন্ধু-বান্ধবের পাল্লায় পড়ে এবং হুজুগে ভর্তি হচ্ছে তথকতিথ সোনার হরিণ সাবজেক্টে। বাবা মা লোন করেও চাইছেন সন্তান ভর্তি হোক। পাবলিকে না পেলে প্রাইভেটে।

আমার প্রশ্ন হলো, যে সকল শিক্ষার্থী চাকরি পেল না তারা কি করবে? তাদের জীবন থেকে পাঁচটি বছর ব্যয় হলো সে হিসাব কিভাবে মিলাবে? আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করি, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা কর্মমুখী না। একটা ছাত্রকে আসলে আমাদের সমাজে বেসিক যে স্কিলগুলো তার প্রয়োজন সেগুলো শিখতে উৎসাহী করা হয় না। সেটা বাসায়, স্কুল-কলেজে এমনকি সমাজেও না। যার ফলে তথাকথিত উচ্চশিক্ষা শেষ করে মানসম্পন্ন কোন কাজ পায় না, আবার তার স্ট্যান্ডার্ড থেকে নিচের কোন কাজ করতেও পারে না। এভাবেই প্রতিবছর তরুণ সমাজের মধ্যে একটি হতাশার স্রোত আমরা লক্ষ্য করি। কেউ কেউ আবার এই বিষয় নিয়ে আন্দোলন করেন, সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলেন, কেউ আবার সরকারি চাকরির বয়স বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করেন।

সব মিলিয়ে চিন্তা করলে দেখা যায় যে আমরা আসলে একটি অজানা গন্তব্যের দিকে প্রতিনিয়ত দৌড়াচ্ছি। আমাদের জীবনের আসলে লক্ষ্য পরিষ্কার না। আমরা প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ভুলের ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের জীবনটাকে নষ্ট করে দিচ্ছি। যে সময়টা একটা মানুষের জীবনের সবচেয়ে বেশি শক্তি-সামর্থের, তারুণ্যের, সেই সময়টা ব্যয় করছি অপ্রয়োজনীয় এই মার্কেটিং নির্ভর বাণিজ্যিক শিক্ষা ব্যবস্থার বলী হয়ে। এই সময়টা একজন তরুণ যদি উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা করত বা জীবনের কোন এসেনশিয়াল স্কিল শেখার চিন্তা করত, তাহলে তার জীবনের সমীকরণ অন্যরকম হতো। বিষয়গুলো অনেক তরুণদের জীবনের গল্প থেকেই নেয়া।

তবে ইদানিং কালের তরুণ প্রজন্মের অনেকেই দেখছি এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফ্রিল্যান্সিং, প্রফেশনাল কাজ, কারিগরি দক্ষতা অর্জন ও কৃষিসহ নতুন উদ্যোগ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। যেটা আসলে আমাদের জেনারেশন করা উচিত ছিল। দেখতে ভালো লাগে যে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনেকেই এখন ভার্সিটি এডুকেশনের যে ইদুর দৌড় তাতে অংশ নিচ্ছে না। নতুন ডাইমেশন থেকে কাজ করতে চাইছে। তরুণদের ডায়নামিক আইডিয়ার মাধ্যমে সমাজে নতুন নতুন উদ্যোগ তৈরি হচ্ছে। আর এই নতুন উদ্যোগ গুলোই আসলে সুস্থ অর্থনীতির চালিকাশক্তি। তরুণ প্রজন্ম এখন চাকরির পিছে না ছুটে ব্যবসায়িকভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চিন্তা ভাবনা করছে। এটি আসলে আশা ব্যঞ্জক। কারণ অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য ক্ষুদ্র উদ্যোগ বা ক্ষুদ্র ব্যবসার কোন বিকল্প নেই। আত্মকর্মসংস্থান সমাজের তরুণ উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি চমৎকার রাস্তা। সমাজে সম্পদের সুষম বন্টন হবে। এক শ্রেণীর হাতে অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি কুক্ষিগত না হয়ে সমাজের সবাই লাভবান হবে। ফলে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো মানুষকে জিম্মি করে অতি মুনাফার সুযোগ কমে যাবে। মানুষ স্বাভাবিকভাবে কম মূল্যে পণ্য কিনতে পারবে এবং ব্যাক্তিগত সঞ্চয় বাড়বে। তখন মানুষের মাঝে ক্ষুদ্র বিনিয়োগের চিন্তার বিকাশ ঘটবে। ফলে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি হবে। মানুষের হতাশা, অস্থিরতা, অশান্তি থাকবে না।

যেহেতু বড় বড় যে জয়েন্ট কোম্পানিগুলোর কর্পোরেট পলিসি হলো মানুষকে আতঙ্কে রেখে নিজের পকেট ভারি করা, তাই আমার এই লেখা হয়তো তাদের অনেকের ভালো লাগবে না। তবে আমার লেখার উদ্দেশ্য হলো ছোট ছোট উদ্যোগকে উৎসাহিত করা। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ইঁদুর দৌড় থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মেধা বিকাশ করে বৈচিত্র্যময় ক্যারিয়ার গঠনের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেয়া তরুণদের জন্য রইলো ভালেবাসা। আশা করি এই বিষয়ে আমি আমার নিজস্ব মতামত আপনাদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছি। বিষয়টি নিয়ে আরো কিছু যদি আপনি বলতে চান, আমার কমেন্ট বক্স খোলা রইল।

লেখকঃ মোস্তাফিজ মাকিন
কবি ও সমাজকর্মী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *