গ্যাসলাইটিং: মানসিক নির্যাতনের অন্য নাম

গ্যাসলাইটিং

ধরুন আপনি একটি কাজ আদতে করেননি, কিন্তু সেই কাজটি আপনি করেছেন বলে আপনাকে ভাবতে বাধ্য করা হচ্ছে। এক পর্যায়ে আপনি নিজেই মেনে নিচ্ছেন যে কাজটি আপনি করেছেন! এতে ধীরে ধীরে হতাশা গ্রাস করছে আপনাকে। খুব ধীরে ধীরে কেউ একজন আপনার মনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আপনাকে এই নির্যাতন করছে। এই পরিস্থিতিতেই বলা হয় ‘গ্যাসলাইটিং।’

কীভাবে এলো গ্যাসলাইটিং শব্দটি?

একটি নাটকের মাধ্যমে শব্দটির প্রচলন শুরু হয়েছিল। ১৯৩৮ সালে ‘গ্যাস লাইট’ নামের একটি নাটক মঞ্চায়িত হয়। এরপর একই গল্প ও নাম অবলম্বনে ১৯৪০ সালে মুক্তি পায় একটি চলচ্চিত্র। পরবর্তীতে কাছাকাছি ধরনের গল্প নিয়ে ১৯৪৪ সালে বয়ার ও ইনগ্রিড বার্গ্যমান অভিনীত সিনেমাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। প্রতিটি গল্পের ধরন ছিল একই। একজন পুরুষ প্রোটাগনিস্ট তার স্ত্রীকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন যে তার সব ভাবনাই মিথ্যা। এমনকি তাদের বাড়ির গ্যাস লাইটের জ্বলা-নেভাও স্ত্রীর অলীক কল্পনা। বাস্তব ঘটনাকে ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে তিনি তার স্ত্রীর সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে এক পর্যায়ে স্ত্রীও নিজেকে পাগল ভাবতে শুরু করেন। গ্যাসলাইটিং আসলে কী এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ম্যানিপুলেশন বলা হয় এই পরিস্থতিকে। অন্য পক্ষের নিয়ন্ত্রণের কারণে নিজের বাস্তব ভাবনার উপর নিজেরই সন্দেহ তৈরি হয় এতে।

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক পেজ সুইট বলছেন, কাউকে পাগল প্রমাণ করার চেষ্টাকেই গ্যাসলাইটিংয়ের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। সম্পর্ক এবং কর্মক্ষেত্রে গ্যাসলাইটিং নিয়ে নিয়মিত পড়াশোনা করছেন এই অধ্যাপক। গ্যাসলাইটাররা বাস্তবতাকে বিকৃত করে এবং তাদের নিজস্ব বিচার এবং অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বাধ্য করে। অন্য ব্যক্তির উপর ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। এক ধরনের মানসিক শোষণ এবং নির্যাতন বলা হয় গ্যাসলাইটিংকে। দাম্পত্য সম্পর্কের পাশাপাশি এটি পারিবারিক বা কর্মক্ষেত্রের সম্পর্কের মধ্যেও ঘটতে পারে।

কীভাবে বুঝবেন আপনি গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার?

কারোর সঙ্গে কথা বললে আপনি বিভ্রান্ত হচ্ছেন বার বার। কেউ মিথ্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। যেটা হয়নি সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। আপনাকে বারবার মানসিক রোগগ্রস্ত হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এক পর্যায়ে আপনি নিজেই মনে করছেন যে আপনার মানসিক ভারসাম্য প্রশ্নবিদ্ধ। আপনি হতাশ হতে শুরু করেছেন। আপনাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে কোনও পক্ষ বা ব্যক্তি। তবে যে মিথ্যার কথা বলা হচ্ছে, সেটা আপনি বলেননি। তুমি সবসময় ভুলে যাও, নিশ্চয় এমনটি ঘটেনি- এই ধরনের বাক্য প্রয়োগের কারণে আপনার নিজেরই মনে হচ্ছে যে আপনার ভুলে যাওয়ার রোগ আছে। কিছু উদাহরণ গ্যাসলাইটিং মানে যে কেবল অন্যকে ‘পাগল’ হিসেবে প্রমাণ করা সেটা নয়। অনেক সময় নানাভাবে অন্যকে অপমান করা এবং নিজের ভাবনা অন্যের উপর তার অজান্তে চাপিয়ে দেওয়াও হতে পারে। যেমন ধরুন বন্ধুদের আড্ডায় এক বন্ধু আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলল অমুক অঞ্চলের লোকজন তো মানুষ হিসেবে অনেক খারাপ। আপনি প্রবাদ করলে আরও হাস্যরস করে সে বলল, আপনি ফান বুঝতে পারছেন না। আবার অতীতে কোনও কিছু করে বা বলে পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে তা অস্বীকার করাও গ্যাসলাইটারদের কাজ। ধরুন আপনাকে সে একটি মেসেজ দিয়েছে। মেসেজটি আপনি হারিয়ে ফেলেছেন। সে তার নিজের প্রয়োজনে বলতে পারে এমন মেসেজ সে কখনোই আপনাকে পাঠায়নি।

কাদের মধ্যে গ্যাসলাইটার হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়?

নার্সিসিস্ট পারসোনালিটি যাদের, তাদের মধ্যে এই সমস্যা দেখা দেয়। ছোটবেলায় কেউ শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও পরবর্তীতে তার মধ্যে এই ধরনের ব্যক্তিত্ব দেখা যেতে পারে। মিথ্যা বলার প্রবণতা বেশি থাকলে গ্যাসলাইটার হওয়া তাদের জন্য সহজ। সঙ্গীকে নিয়ে সন্দেহ কাজ করলে এই আচরণ করে অনেকে।

গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হলে কী করবেন?

যদি বুঝতে পারেন যে আপনি গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হচ্ছেন, তবে নিজের আত্মবিশ্বাস বজায় রাখার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, আপনাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দেওয়াই গ্যাসলাইটারদের উদ্দেশ্য। কাউকে গ্যাসলাইটার বলে সন্দেহ করলে তার সঙ্গে খুব সাবধানে যোগাযোগ করবেন। সেই যোগাযোগের খুঁটিনাটি রেকর্ড করে রাখবেন। কেউ কিছু বললেই সেটা বিশ্বাস করে ফেলবেন না। পরখ করে তারপর বিশ্বাস করুন। কারণ গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হতে পারেন যেকোনো সময়ই- এটা মনে রাখবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *